ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫ , ২৪ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

​আজ বেগম রোকেয়া দিবস

মুছে যাচ্ছে বেগম রোকেয়ার স্মৃতি, নেই সংরক্ষণের উদ্যোগ

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ০৯-১২-২০২৪ ০৩:৫০:০৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০৯-১২-২০২৪ ০৩:৫০:০৩ অপরাহ্ন
মুছে যাচ্ছে বেগম রোকেয়ার স্মৃতি, নেই সংরক্ষণের উদ্যোগ
আজ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে তার জন্মভূমি রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিকেন্দ্র। মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র মিলে বেশ সমৃদ্ধ এটি। আলো ছড়ানো কেন্দ্রটি গত ছয় বছর ধরে আঁধারে ঢাকা। এটি খোলার উদ্যোগ নেই কারও। স্মৃতিকেন্দ্রটি একটি ভবনেই শুধু সীমাবদ্ধ। পাশাপাশি দখলদারদের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে যেতে বসেছে বেগম রোকেয়ার বসতভিটা। চার পাশে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। এসব স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই জেলা প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে রোকেয়ার বসতভিটা। সেখানে কোনও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংরক্ষণের অভাবে দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ ক্রমেই মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ঘরের একটি জানালা ও কয়েকটি পিলার এখনও টিকে আছে। এসব দেখে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বেগম রোকেয়ার অনুরাগীরা ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেন। 
অপরদিকে, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ঘুরতে এসে রোকেয়া সম্পর্কিত তেমন কিছু না পেয়ে হতাশ দর্শনার্থীরা। ভেতরে নেই স্মৃতিচিহ্ন। মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র সবই আছে, কিন্তু সব কক্ষের দরজায় ঝুলছে তালা। সংস্কারের অভাবে ভবনের পলেস্তারা খসে পড়ছে। দৃষ্টিনন্দন মিলনায়তনটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। বেশিরভাগ কক্ষের জানালার কাচ ভাঙা। সংগ্রহশালার ধূলিমলিন কাচের আলমারিগুলোতে নেই কোনও স্মারক। সব কক্ষের দেয়ালে পড়ে আছে শ্যাওলা। ভেতরের জিনিসপত্র এবং আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাকি জিনিসপত্র। নেই সংস্কারের উদ্যোগ। কার্যত ছয় বছর ধরে স্মৃতিকেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একদিন উৎসব করে রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। এজন্য কয়েকদিন আগে থেকে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটার খোঁজ করতে থাকেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। দিনটি ঘিরে স্মৃতিকেন্দ্রটির ধোয়ামোছা, রঙ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। হয় আলোচনা সভা, সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চলে বড় বড় বক্তৃতার প্রতিযোগিতা। একদিন পরেই আর কারও কোনও খোঁজ থাকে না। বছরের বাকি দিন অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটা। রোকেয়ার স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার কোনও পদক্ষেপ নেই। স্মৃতিকেন্দ্রটির কার্যক্রম ছয় বছর ধরে বন্ধ থাকলেও খোলার উদ্যোগ নেই। 
বেগম রোকেয়ার মরদেহ ভারত থেকে দেশে আনার দাবি দীর্ঘদিনের। স্থানীয়রাসহ রোকেয়াপ্রেমীদের প্রত্যাশা, রোকেয়ার মরদেহ ভারত থেকে নিয়ে এসে পায়রাবন্দের মাটিতে সমাহিত করা হয়। এই দাবি যেন জেলা প্রশাসন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।
স্মৃতিকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০১ সালের ১ জুলাই এটির উদ্বোধন করা হয়। রোকেয়ার বসতভিটার সোয়া তিন একর জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয় তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রকল্প ছিল, যা বাংলা একাডেমি দ্বারা পরিচালিত হতো। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০০৪ সালের ৫ অক্টোবর স্মৃতিকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে তা একই বছর এটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যায়। ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা অবস্থায় ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এটি বিকেএমইর সেলাই কারখানা হয়েছিল। এরপর এই স্মৃতিকেন্দ্র চালু থাকলেও কোনও কার্যকারিতা ছিল না। ২০১৭ সালের ২৯ মে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটিকে রাজস্ব খাতে নিয়ে বাংলা একাডেমির কাছে দেয়। স্মৃতিকেন্দ্রের ভবনটির মধ্যে রয়েছে ৩০০ আসনের মিলনায়তন, ১০০ আসনের সেমিনার কক্ষ, ১০ হাজার বই ধারণক্ষমতার গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা, প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসকক্ষ। এ ছাড়াও দুটি অতিথি ভবন রয়েছে। তবে বর্তমানে একজন সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ও সহ-গ্রন্থাগারিক ছাড়া কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। গ্রন্থাগারে বই নেই। গবেষণাকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা খালি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কয়েক বছর আগে সংগীত শিক্ষার দুটি হারমোনিয়ামসহ অন্যান্য সামগ্রী ছিল, সেগুলো এখন নেই। 
রোকেয়াপ্রেমী ও ভক্তরা বলছেন, নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম নারীদের যে অগ্রগতি হয়েছিল, তার পেছনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্মময় জীবন অন্তহীন প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। তার দেখানো পথে হেঁটে নারীরা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও পথপ্রদর্শকের জন্মস্থান ও স্মৃতিকেন্দ্র ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি জন্মস্থান সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও রোকেয়া গবেষক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘এত বছরেও শেখ হাসিনা সরকার বেগম রোকেয়ার স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। এজন্য রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও তার বসতভিটা হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ৫ আগস্ট আমরা নতুন বাংলাদেশ পেলাম। তবে এখনও বৈষম্য দূর হয়নি। আশা করছি, বর্তমান সরকার রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও তার বসতভিটা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে।’ 
রফিকুল ইসলাম দুলাল আরও বলেন, ‘ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম রোকেয়ার গ্রাফিতিতে কালো রঙ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার নামে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব ভালো লক্ষণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি, বেগম রোকেয়ার সমাধি কলকাতা থেকে সরিয়ে তার জন্মভূমিতে যেন স্থানান্তর করা হয়। সেটির বাস্তবায়ন চাই আমরা। সেইসঙ্গে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র আবারও চালু করার দাবি জানাই।’
চট্টগ্রাম থেকে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটা দেখতে আসা মাসুদা পারভীন এবং তার স্বামী মো. আখতারুজ্জামান বলেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বসতভিটা অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। স্মৃতিকেন্দ্রের অবস্থা বেহাল। এগুলো খুবই দুঃখজনক। সংরক্ষণের দাবি জানাই।বাগেরহাট থেকে আসা মৌসুমী সুলতানা বলেন, ‘স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটা দেখতে এসে হতাশ হলাম। আশা করছি, বেগম রোকেয়ার বসতভিটা ও স্মৃতিকেন্দ্রটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে বর্তমান সরকার।’
স্মৃতিকেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক আবিদ করিম মুন্না বলেন, ‘রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের সব কার্যক্রম বন্ধ। তবে চালু হওয়ার আশা করছি। স্মৃতিকেন্দ্র দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলা একাডেমিকে বলেছি, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বই দিতে। নারীদের প্রশিক্ষণ ও সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথাও বলেছি আমরা।’
রোকেয়া দিবস উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যায় স্মৃতিকেন্দ্রের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ দেখতে আসেন রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র চালুর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করছি, এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে। সেইসঙ্গে বসতভিটা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

বাংলা স্কুপ/ প্রতিনিধি/ এনআইএন/এসকে 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ